আমরা জানি, সকল রাসায়নিক বিক্রিয়ায় বিক্রিয়ক পদার্থ উৎপাদে পরিণত হয়। কোনো কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়ায় বিক্রিয়ক উৎপাদে পরিণত হতে 1 সেকেন্ডের কম সময় লাগে। আবার, কোনো কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়ার বিক্রিয়ক উৎপাদে পরিণত হতে অনেক বেশি সময় লাগে।
একক সময়ে যে পরিমাণ বিক্রিয়ক উৎপাদে পরিণত হয় তাকে বিক্রিয়ার হার বলে।
যেমন: Nacl কৰণে AgNO3, যোগ করার পর 1 সেকেন্ডের কম সময়ে AgCl এর সাদা অধঃক্ষেপ উৎপন্ন করে। আবার, লোহার তৈরি একটি ব্রিজে মরিচা পড়তে অনেক দিন সময় লাগে।
বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়া সম্পন্ন হতে বিভিন্ন সময় নেয়। যে বিক্রিয়া অল্প সময়ে সংঘটিত হয় সে বিক্রিয়ার গতিবেগ বা হার বেশি, আবার যে বিক্রিয়ায় অনেক বেশি সময়ে সংঘটিত হয় সে বিক্রিয়ার গতিবেগ বা হার কম।
আমরা জানি, উভমুখী বিক্রিয়ায় বিক্রিয়ক পদার্থগুলো পরস্পরের সাথে বিক্রিয়া করে উৎপাদে পরিণত হয়, এই বিক্রিয়াকে সম্মুখবর্তী বিক্রিয়া বলে। আবার, উৎপাদ পদার্থগুলো পরস্পরের সাথে বিক্রিয়া করে বিক্রিয়কে পরিণত হয়, এই বিক্রিয়াকে পশ্চাৎমুখী বিক্রিয়া বলে। বিক্রিয়ার শুরুতে সম্মুখবর্তী বিক্রিয়ার হার অনেক বেশি থাকে। যতই সময় যেতে থাকে সম্মুখবর্তী বিক্রিয়ার হার ততই কমতে থাকে।
আবার, বিক্রিয়ার শুরুতে পশ্চাৎমুখী বিক্রিয়ার হার কম থাকে। যতই সময় পার হয় পশ্চাৎমুখী বিক্রিয়ার হার ততই বাড়তে থাকে। এক সময় সম্মুখবর্তী বিক্রিয়ায় হার এবং পশ্চাৎমুখী বিক্রিয়ায় হার সমান হয়ে যায়৷ এ অবস্থাকে উভমুখী বিক্রিয়ার সাম্যাবস্থা বলা হয়।
সাম্যাবস্থায় সম্মুখবর্তী বিক্রিয়া এবং পশ্চাৎমুখী বিক্রিয়া চলতে থাকে, যে পরিমাণ বিক্রিয়ক সম্মুখবর্তী বিক্রিয়ায় উৎপাদে পরিণত হয়েছে, পশ্চাৎমুখী বিক্রিয়ায় উৎপাদ থেকে ঠিক সেই পরিমাণ বিক্রিয়ক উৎপন্ন হয়েছে (চিত্র 7.05)। কাজেই সাম্যাবস্থায় বাহ্যিকভাবে মনে হয় বিক্রিয়াটি বুঝি থেমে গেছে, কিন্তু বাস্তবে সেটি থেমে নেই। তবে সাম্যাবস্থায় বিক্রিয়ার নিয়ামক তাপ, চাপ, ঘনমাত্রা এগুলো পরিবর্তন করলে সাম্যাবস্থাও পরিবর্তিত হয়ে যায়। উভমুখী বিক্রিয়ায় সাম্যাবস্থায় উৎপাদের পরিমাণ বৃদ্ধি বা হ্রাস লা-শাতেলিয়ার নীতি দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়। লা-শাতেলিয়ার নীতিটি হচ্ছে:
কোনো বিক্রিয়ার সাম্যাবস্থায় থাকাকালীন যদি তাপ, চাপ, ঘনমাত্রা ইত্যাদি পরিবর্তন করা হয় তবে সাম্যের অবস্থান এমনভাবে পরিবর্তিত হয় যেন তাপ, চাপ, ঘনমাত্রা ইত্যাদির পরিবর্তনের ফলাফল প্রশমিত হয়।
লা-শাতেলিয়ার নীতির ব্যাখ্যা
তাপ, চাপ কিংবা ঘনমাত্রার প্রভাবে সাম্যাবস্থার কী ধরনের পরিবর্তন হয় লা-শাতেলিয়ার নীতির মাধ্যমে সেটি খুব সহজে ব্যাখ্যা করা যায়।
সাম্যাবস্থার উপর তাপের প্রভাব একটি উভমুখী বিক্রিয়া বিবেচনা করা যাক:
N2 + 3H2 2NH3 + 92 kJ
এই বিক্রিয়ার সম্মুখমুখী অংশটি তাপ উৎপাদী, অর্থাৎ যখন N2 এবং H, বিক্রিয়ক তখন উৎপাদ NH3 উৎপন্ন হওয়ার সময় বিক্রিয়াটি তাপ উৎপাদন করে। এই বিক্রিয়ার বিপরীতমুখী অংশটি তাপহারী, অর্থাৎ NH, কে ভেঙে N2 এবং H2 উৎপন্ন করার সময় তাপ শোষিত হয়, কাজেই এর জন্য তাপ প্রয়োগ করতে হয়। আমরা এখন লা-শাতেলিয়ার নীতির ভিত্তিতে দেখতে চাই এই উভমুখী বিক্রিয়ায় তাপ প্রয়োগ করা হলে কী ঘটবে। লা-শাতেলিয়ার নীতি অনুযায়ী তাপ প্রয়োগ করা হলে তাপ বৃদ্ধিজনিত ফলাফল প্রশমিত হতে হবে। তাপ প্রয়োগ করা হলে যদি সম্মুখমুখী তাপ উৎপাদী বিক্রিয়াটি বৃদ্ধি পায় তা হলে আরো বেশি তাপ উৎপাদিত হবে এবং ফলাফল প্রশমিত না হয়ে আরো বৃদ্ধি পাবে। যদি বিপরীতমুখী তাপহারী বিক্রিয়াটি বৃদ্ধি পায় তাহলে সেটি তাপ শোষণ করে তাপ বৃদ্ধিজনিত ফলাফল প্রশমিত করবে। কাজেই লা-শাতেলিয়ার নীতি অনুযায়ী আমরা বলতে পারি তাপমাত্রা বৃদ্ধি করা হলে বিপরীতমুখী তাপহারী বিক্রিয়াটি বৃদ্ধি পাবে। অন্যভাবে বলা যায়, তাপোৎপাদী বিক্রিয়ায় তাপ প্রয়োগ করলে সাম্য ডান দিক থেকে বাম দিকে সরে যায় অর্থাৎ NH3, ভেঙে N2 ও H2 উৎপন্ন
করে।
একই যুক্তিতে আমরা বলতে পারি, বিক্রিয়ার সাম্যাবস্থায় তাপমাত্রা হ্রাস করা হলে সম্মুখমুখী তাপ উৎপাদী বিক্রিয়াটি বৃদ্ধি পাবে এবং তাপ হ্রাসজনিত ফলাফল প্রশমিত করবে। অর্থাৎ সাম্য বাম দিক থেকে ডান দিকে সরে যাবে। যে সকল বিক্রিয়ায় তাপের পরিবর্তন হয় না সে সকল বিক্রিয়ায় সাম্যাবস্থার উপর তাপমাত্রার কোনো প্রভাব নেই।
এবারে আরেকটি বিক্রিয়া বিবেচনা করা যাক। এই বিক্রিয়ার সম্মুখমুখী অংশটি তাপহারী এবং বিপরীতমুখী অংশটি তাপ উৎপাদী।
N2 + O2 + 180 kJ 2NO
এই বিক্রিয়ায় তাপ প্রয়োগ করা হলে সম্মুখমুখী তাপহারী বিক্রিয়া বৃদ্ধি পাবে, কিংবা সাম্য বাম দিক থেকে ডান দিকে সরে যাবে অর্থাৎ N2 ও O2 বিক্রিয়া করে NO উৎপন্ন হবে। আবার, সাম্যাবস্থায় তাপমাত্রা হ্রাস করা হলে বিপরীতমুখী তাপ উৎপাদী বিক্রিয়া বৃদ্ধি পাবে অর্থাৎ সাম্য ডান দিক থেকে বাম দিকে সরে যাবে অর্থাৎ NO ভেঙে N2 এবং O, উৎপন্ন হবে।
সাম্যাবস্থার উপর চাপের প্রভাব
যে সকল বিক্রিয়ায় বিক্রিয়ক ও উৎপাদের মধ্যে যেকোনো একটি গ্যাসীয় বা সবই গ্যাসীয় অবস্থায় থাকে সেসব বিক্রিয়ায় সাম্যাবস্থার উপর চাপের প্রভাব থাকে। সাম্যাবস্থায় বিক্রিয়কের মোট মোল সংখ্যা এবং উৎপাদের মোট মোল সংখ্যার পরিবর্তন হলে সাম্যাবস্থার উপর চাপের প্রভাব থাকবে। যেমন:
N2 (g) + 3H2 (g) 2NH3 (g)
লা-শাতেলিয়ার নীতি অনুসারে সাম্যাবস্থায় চাপ প্রয়োগ করা হলে চাপ বৃদ্ধিজনিত ফলাফল প্রশমিত হতে হবে। একই আয়তনে গ্যসের মোল সংখ্যা বেশি হলে চাপ বেশি হয় এবং মোল সংখ্যা কম হলে চাপ কম হয়। উপরের উভমুখী বিক্রিয়ায় বাম দিকে গ্যাসীয় উৎপাদে মোল সংখ্যা বেশি (1+3 = 4) এবং ডান দিকে কম (2)। কাজেই চাপ বৃদ্ধিজনিত ফলাফল প্রশমিত করার জন্য বিক্রিয়াটির গ্যাসীয় উপাদান বেশি মোল থেকে কম মোলের দিকে যেতে হবে। অর্থাৎ বিক্রিয়ার সম্মুখমুখী অংশটি বৃদ্ধি পেয়ে N2 ও H2 বিক্রিয়া করে NH3 উৎপন্ন করবে। অন্যভাবে বলতে পারি, বেশি মোল থেকে কম মোলের দিকে সাম্য সরে যাবে। কাজেই সাম্যাবস্থায় চাপ কমিয়ে দিলে লা-শাতেলিয়ার নীতি অনুসারে চাপ হ্রাসজনিত ফলাফল প্রশমিত করার জন্য বা চাপ বাড়ানোর জন্য কম মোল থেকে বেশি মোলের দিকে সাম্য সরে যাবে।
আমরা আরো একটি উভমুখী বিক্রিয়া বিবেচনা করতে পারি:
N2(g) + O2(g) 2NO(g)
এই বিক্রিয়ায় বিক্রিয়ক এর মোট মোল সংখ্যা 1 + 1 = 2 এবং উৎপাদের মোল সংখ্যাও 2, অর্থাৎ এই বিক্রিয়ায় মোলের পরিবর্তন হয় না, কাজেই চাপেরও পরিবর্তন হয় না। অন্যভাবে বলতে পারি, এই বিক্রিয়ার সাম্যাবস্থায় চাপের কোনো প্রভাব নেই।
সাম্যাবস্থার উপর ঘনমাত্রার প্রভাব
সকল বিক্রিয়ার সাম্যাবস্থার উপর বিক্রিয়কের ঘনমাত্রার প্রভাব রয়েছে। বিক্রিয়ার সাম্যাবস্থায় যে কোনো একটি বিক্রিয়কের ঘনমাত্রা বাড়ালে লা-শাতেলিয়ার নীতি অনুসারে বিক্রিয়কের ঘনমাত্রা কমিয়ে পরিবর্তনের ফলাফলকে প্রশমিত করার জন্য উৎপাদের পরিমাণ বৃদ্ধি হতে হবে। আমরা বলতে পারি, এখানে বিক্রিয়ার সাম্যাবস্থা ডান দিকে অগ্রসর হয়। একইভাবে বিক্রিয়ার সাম্যাবস্থায় যেকোনো একটি উৎপাদের ঘনমাত্রা বাড়ানো হলে উৎপাদের পরিমাণ কমানোর জন্য বিক্রিয়াটি বিপরীত দিকে ঘটতে থাকে এবং বিক্রিয়কের ঘনমাত্রা বৃদ্ধি হতে থাকে। অন্যভাবে বলতে পারি, সাম্যাকথা বাম দিকে অগ্রসর হয়।
আরও দেখুন...